রাজশাহী পলিটেকনিকেও রয়েছে ছাত্রলীগের টর্চার সেল: আটক-৯

রাজশাহী পলিটেকনিকেও রয়েছে ছাত্রলীগের টর্চার সেল: আটক-৯

রাজশাহী পলিটেকনিকেও রয়েছে ছাত্রলীগের টর্চার সেল: আটক-৯
রাজশাহী পলিটেকনিকেও রয়েছে ছাত্রলীগের টর্চার সেল: আটক-৯

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ এর উপর হামলা এবং তুলে পুকুরে ফেলে দেওয়ার ঘটনায় মহানগরীর চন্দ্রিমা থানায় ৮জন আসামীর নাম উল্লেখ করে ৫০ জন অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা রুজু করা হয়।

আজ সোমবার ভোর রাতে চন্দ্রিমা থানা পুলিশ ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ যৌথ ভাবে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এর সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের সনাক্তমতে  মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ঘটনার সাথে জড়িত মূল আসামীকে গ্রেফতার করেছে।

গ্রেফতারকৃত হলেন, নগরীর চন্দ্রিমা থানাধিন আসাম কলোনী, এলাকার রবিউল ইসলামের ছেলে মেহেদী হাসান আশিক(২২), শাহ আলমের ছেলে মেহেদী হাসান হিরা(২৩), ও ছাটবনগ্রাম এলাকার খন্দকার আলমগীরের ছেলে মোঃ নজরুল ইসলাম(২৩), নগরীর বোয়ালিয়া থানাধিন সাধুর মোড়, এলাকার নোমানের ছেলে নাবিউল উৎস(২০)।

চন্দ্রিমা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ মোঃ গোলাম মোস্তফা জানান, গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অন্যান্য আসামীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যহত রয়েছে।

এর আগে গতকাল রবিবার গ্রেফতার হওয়া পাঁচজন হলেন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের পঞ্চম পর্বের ছাত্র আরিফুল ইসলাম আরিফ (২০), উপ-পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ও ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের সপ্তম পর্বের বাঁধন রায় (১৯), ছাত্রলীগ কর্মী ও ইলেকট্রমেডিক্যাল বিভাগের পঞ্চম পর্বের সোহেল রানা (২০), ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের পঞ্চম পর্বের সাফি শাহরিয়ার (২৪), সোহেল রানা (২২) এবং ইলেকট্রনিক্স বিভাগের তৃতীয় পর্বের রিপন আলী (২০)।

মামলা দায়েরের পর রাতেই নগরীর বিভিন্ন ছাত্রাবাসে অভিযান চালিয়ে ২৫ জনকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়। এদের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে এবং সিসিটিভির ফুটেজ দেখে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচজনকে দন্ড-বিধির ১৪৩, ৪৪৮, ৩৪১, ৩৫৩ ও ৩২৩ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। অন্যদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

গ্রেফতার পাঁচজনকে গতকাল রোববার আদালতের মাধ্যমে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের রিমান্ডের জন্য আদালতে আবেদন জানানো হবে বলে জানান ওসি।

জানা যায়, রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষকে জোর করে তুলে নিয়ে পুকুরে ফেলে দেয়ার ঘটনায় তিন সদস্যের কমিটি করেছে কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর। গত রোববার এ কমিটি গঠন করা হয়।

বিকেলে কমিটির সদস্যরা রাজশাহী পৌঁছে তদন্ত শুরু করেন। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও ছাত্রদের সাথে কথা বলেন এবং সিসিটিভির ফুটেজ দেখেন।

কেবল বুয়েটেই নয়, রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে এবার সন্ধান পাওয়া গেছে শিক্ষার্থী নির্যাতনে ব্যবহৃত একটি কক্ষের। প্রতিষ্ঠানটির ১১১৯ নম্বর কক্ষকে ছাত্রলীগ বানিয়েছিল ‘টর্চার সেল’।

রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তিন তলা প্রশাসনিক ভবনের উত্তর পাশের দ্বিতীয় তলা ভবনের নিচতলার ১১১৮ নম্বরটি ছাত্রদের কমনরুম। পাশের ১১১৯ নম্বর রুমটি সবসময় তালাবদ্ধ থাকতো। রুমের একটি চাবি থাকত ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে। রুমটি ছাত্রলীগের টর্চার সেল হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।

রাজশাহী পলিটেকনিকে ছাত্রলীগের টর্চার সেল

গতকাল রোববার ওই রুমের তালা খুলে দেখা যায়, টেবিলের ওপর কয়েকটি বাঁশের লাঠি, লোহার রড ও পাইপ পড়ে আছে।

একাধিক শিক্ষার্থীরা জানান, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কারো ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রাগ করলে তাকে সাধারণত প্রশাসনিক ভবনের সামনে তাদের দলীয় টেন্টে চড়-থাপ্পড় দেওয়া হতো। এর চেয়ে কাউকে বেশি শাস্তি দিতে হলে তাকে টর্চার সেলে ধরে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারপিট করা হতো।

গতকাল রোববার পলিটেকনিক ক্যাম্পাসে গেলে, অনেক শিক্ষার্থীই মুখ খোলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে। তবে ভয়ে তারা কেউ নিজেদের পরিচয় দিতে চাননি।

তাঁরা জানান, সংবাদ মাধ্যমে নাম এলে ছাত্রলীগ তাদের চিহ্নিত করতে রাখবে। ইনস্টিটিউটের বাইরে তাঁকে পেলে ছাত্রলীগ এর প্রতিশোধ নেবে।

এক ছাত্র জানায়, কয়েক মাস আগে তিনিসহ চারজন ছাত্রদের কমনরুমে ক্যারাম খেলছিলেন। হঠাৎ পাশের ১১১৯ নম্বর রুম থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পান তারা। কমনরুমের বারান্দায় গিয়ে দেখেন ১১১৯ নম্বর রুমের দরজা খোলা। এক ছাত্রকে মেঝেতে ফেলে ১০ জন মিলে মারছে। তাদের দেখতে পেয়ে ছাত্রলীগের এক ছেলে রুম থেকে বাইরে এসে চার ছাত্রকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে যা দেখেছে তা বাইরে প্রকাশ না করার জন্য শাসিয়ে যান।

অপর এক ছাত্র জানান, চতুর্থ পর্বের মিডটার্ম পরীক্ষায় ছাত্রলীগের এক নেতাকে খাতা দেখে লিখতে দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁর বন্ধুকে টর্চার সেলে ধরে নিয়ে যান ছাত্রলীগের ওই নেতাসহ কয়েকজন। সেখানে তাঁকে এক ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করা হয়। পরে তাঁর সহপাঠীরা যখন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যায়, তখন নির্যাতিত ছাত্রটি হাঁটতে পারছিলেন না।

ছাত্রলীগের এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা অহরহই ঘটতো রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে।

ক্লাস চলাকালে শিক্ষকদের সামনে থেকে টার্গেট করা শিক্ষার্থীকে বের করে নিয়ে গিয়ে মারধর করত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

কোনো ছাত্রীকে ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মী পছন্দ করলে তার সঙ্গে প্রেম করতে বাধ্য করা হতো বলেও অভিযোগ করেছে অনেক ছাত্রী।

শিক্ষার্থীদের এসব অভিযোগ স্বীকার করেছেন রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষকরা।

কিছুদিন আগে এক শিক্ষার্থীকে দলীয় টেন্টে মারধর করার প্রতিবাদ করায় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকের ওপর চড়াও হয়েছিলেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। পরে ওই শিক্ষক শিক্ষকদের কমনরুমে আশ্রয় নিয়ে রক্ষা পান।

ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মো. নুর উল্লাহ জানান, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে একটি নির্দিষ্ট চত্বরে বসে এবং বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে নিরীহ শিক্ষার্থীদের প্রায়ই মারধর করে।

শিক্ষকরা জানান, পরীক্ষার হলে নকল করতে না দিলে, অন্যদের খাতা দেখে লিখতে না দিলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষকদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করত। এ ছাড়া ফেল করা ছাত্রদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাকে পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের চাপ দিত ছাত্রলীগের নেতারা। শিক্ষকদের কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত করার হুমকি দিত ছাত্রলীগের নেতারা।

শিক্ষকরা কোন এলাকার কোন বাড়িতে থাকেন, পরিবারে কে-কে আছেন, প্রতিবাদকারী শিক্ষকদের সেসব কথা শুনিয়ে দিতেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ফলে পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে শিক্ষকদের কেউ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ঘাটতে যেতেন না।

দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত কল্যাণ তহবিলের টাকা শতভাগ ছাত্রলীগের ছেলে-মেয়েদের দিতে হবে এমন দাবি এসেছিল জানিয়ে অধ্যক্ষ বলেন, “প্রথমদিকে আমাকে ৬০ শতাংশ টাকা তাদের (ছাত্রলীগ) দিয়ে বাকিটা দরিদ্র ছাত্রদের দিতে হতো।

এর আগে, এখানে কল্যাণ তহবিলে দেওয়ার কোনো সংস্কৃতি ছিল না, ওরাই সব নিয়ে যেত।”এছাড়াও, প্রতিষ্ঠানের যেকোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করলেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে বলেও জানান তিনি।

মতিহার বার্তা ডট কম – ০৪ নভেম্বর ২০১৯

খবরটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply